হাতিরঝিল - দুর্বিষহ অবস্থা থেকে একটু স্বস্তি
ব্যস্ত শহর ঢাকা। ইট-পাথরের
যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত এই শহরে মানুষের যেন স্বস্তির নিশ্বাস নেয়ারও সুযোগ নেই। নাগরিক জীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে আপনাকে একটু হলেও স্বস্তি দেবে হাতিরঝিল।
শুধু দূরে কোথাও ভ্রমণে গেলেই আপনার মনের ক্লান্তি দূর হবে এমনটা ভাবলে ভুল করছেন। দূরে কোথাও ভ্রমণে যেতে হলে আপনাকে যে প্রস্তুতি নিতে হবে, তাতেও হয়তো কিছুদিন সময় ব্যয় হয়ে যাবে। তবে ছুটির দিনে খুব সহজেই আপনি নিজেকে একটু চাঙা করে তুলতে পারেন। শুধু আপনার একটু ইচ্ছা থাকলে দিনে অথবা রাতে, যেকোনো সময় ঘুরে আসতে পারেন হাতিরঝিল থেকে। আর আনন্দ-উল্লাস করে বিসর্জন দিতে পারেন মানসিক চাপকে।
রাজধানীর হাতিরঝিল বর্তমানে মনোরম এক বিনোদন কেন্দ্র। যান্ত্রিক ঢাকার এই জায়গাটির একপাশে সবুজ আর অন্যদিকে ঝিলের টলটলে পানি। যদিও
শুকনো মৌসুমে ঝিলের পানিকে আপনার টলমলে মনে নাও হতে পারে।
আধুনিক পার্কের আদলে
তৈরি হাতিরঝিলের লক্ষ্য হচ্ছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং রাজধানী
ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি
করা। হাতিরঝিল চালুর ফলে ঢাকার তেজগাঁও, গুলশান, মগবাজার এলাকার
সাথে বাড্ডা, রামপুরা, এলাকার সরাসরি যোগাযোগ
স্থাপন হয়েছে।
প্রাচীন ঢাকায় ভাওয়ালের রাজাদের পোষা হাতি রাখা হতো
পিলখানায়। সেই সময় গোসল করার জন্য এসব হাতিদের নিয়ে যাওয়া হতো
হাতিরঝিলে। ঝিলে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করত এখনকার
এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল এলাকা।
হাতিদের আনাগোনার কারণেই এলাকার নামের সাথে ‘হাতি’
শব্দটি যুক্ত হয়ে গেছে। আর হাতি গোসল করানোর কারণে ঝিলের নাম হয়
হাতিরঝিল।
হাতিরঝিল মূলত পরিপাটি
করে গড়ে তোলা একটি অবসর যাপনের শহুরে পার্ক। ঝকঝকে রাস্তা, সুন্দর
করে সাজানো বাহারি গাছের সারি, ওয়াকওয়ে, কংক্রিটের বেঞ্চ দিয়ে সাজানো হয়েছে হাতিরঝিল। রয়েছে কয়েকটি
ওভারাপাস আর দৃষ্টিনন্দন সেতু, সন্ধ্যার পর এসব জায়গায় জালানো হয় বিভিন্ন
রঙের আলো ঝলমলে বাতি। বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরতে আসা মানুষদের জন্য
বসানো হয়েছে ছোট ছোট ক্যাফে বা রোড সাইড রেস্টুরেন্ট। এসব জায়গায়
চা কফি খেতে খেতে সেরে নেয়া যায় বিকেল অথবা সন্ধ্যার হালকা নাস্তা।
হাতিরঝিলকে আরো আকর্ষণীয়
করে তুলেছে ফুলের পাপড়ি আকৃতির বৃত্তাকার কাঠামোয় তৈরি একটি উন্মুক্ত মঞ্চ বা অ্যাম্ফিথিয়েটার। দেখলে মনে
হবে মঞ্চটি পানির ওপর ভাসছে। হাতিরঝিলের গুলশান আড়ং ও পুলিশ প্লাজার মাঝামাঝি অংশেই এর
অবস্থান।
অ্যাম্ফিথিয়েটারের খোলা আকাশের নিচে মুক্ত হাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে ১২০ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্ণিল
ফোয়ারা। মিউজিকের সাথে
তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে এসব ফোয়ারাগুলো। সাথে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি। এটি দক্ষিণ
এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন। এর ফোয়ারার পানি ১০ মিটার থেকে ৮০ মিটার পর্যন্ত ওপরে উঠতে
পারে। মিউজিক্যাল ড্যান্সিং ফাউন্টেইন এবং অ্যাম্পিথিয়েটারের বাড়তি বিনোদন উপভোগ করার
সুযোগ মিলে বিভিন্ন উৎসবে। এছাড়া মাঝে মধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা এবং রাত সাড়ে ৯টায়
১৫ মিনিটের জন্য চালু করা হয় এ বর্ণিল ফোয়ারা।
ঢাকার যেকোনো এলাকা থেকে
সহজেই যাওয়া যায় হাতিরঝিলে। নিজেদের গাড়ি থাকলে তো
কথাই নেই। তবে
হাতিরঝিল ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে হাটতে হবে খানিকটা। আর হাটতে না চাইলে ব্যাবহার
করতে হবে চক্রাকার বাস সার্ভিস। এসব বাস ঢাকার
অন্যান্য সব সাধারণ বাসের থেকে একটু ভিন্ন। প্রায়
৩২-৪৬ জনের আসন ভেতরে এমনভাবে রয়েছে যাতে আসন গ্রহণকারী সবাই মুখোমুখি বসতে পারে।
অনেকটা বাইরের দেশের মেট্রোরেলের আসন বিন্যাসের মতো। এই বাসের সার্ভিস চালু থাকে
সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। বাসটি যাত্রা শুরু করে কাওরান বাজারের এফডিসি
থেকে এবং রামপুরা, বনশ্রী হয়ে শুরুর
স্থানেই শেষ হয়।
হাতিরঝিলে সর্বমোট ৮টি স্টপেজ রয়েছে। এক স্টপেজ
থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত ১০ টাকা। হাতিরঝিলের এক মাথা হতে আরেক মাথায় যাওয়ার জন্য
আপনার লাগবে মাত্র ২০ টাকা। আর পুরো হাতিরঝিল ঘুরে আসতে লাগবে মাত্র ৩০ টাকা। এই
বাস সার্ভিস শুধু বিনোদনের উদ্দেশে আসা মানুষদেরই নয় বরং অনেক চাকরিজীবী ও
অন্যান্য পেশার মানুষদেরও জীবনযাত্রা সহজ করে দিয়েছে।
এছাড়া হাতিরঝিলে বর্তমানে যাত্রীবাহী ওয়াটারবাস চলাচল করে। এটি যেমন
দিচ্ছে মনোরম এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, তেমনি যানজটহীন গুলশান থেকে কাওরান বাজারের দূরত্ব অতিক্রম করা যাচ্ছে
সহজে। এখন ৫টি ওয়াটারবাস চলছে। এক একটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৪৫ জন। নিয়মিত
যাত্রীদের সাথে প্রতিদিন বেড়াতে আসে ট্যুরিস্ট।
হাতিরঝিল লেকে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস সকাল ৭টা
থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। এফডিসি টার্মিনাল থেকে গুলশান টার্মিনালে যেতে সময়
লাগে ২০ মিনিট। এর চেয়েও ৫ মিনিট কমে ট্যাক্সি পৌঁছে যায় রামপুরা টার্মিনালে।
এফডিসি থেকে রামপুরা টার্মিনাল পর্যন্ত ২৫ টাকা ও গুলশান টার্মিনাল পর্যন্ত ৩০
টাকা টিকিটের মূল্য। ট্যাক্সির ভেতরে একটি মিনি ক্যান্টিন রয়েছে। যাত্রীরা ওখান
থেকে বিস্কুট, কেক, কোমল পানীয় ও হালকা খাবার কিনে খেতে পারেন।
x
No comments