লটকন খাওয়ার সাথে ইতিহাস দর্শন – উয়ারী ও বটেশ্বর
বেড়াতে যাওয়া মানেই কি অনেকদিনের প্ল্যান আর গোছগাছ যোগাড়-যন্ত্রে ঝক্কি? আর কেবল পাহাড়, নদী, সমুদ্রের হাতছানি? এর বাইরেও কিন্তু ঝটিকা ভ্রমণ হতেই পারে। তাতে যেমন নেই অনেক খরচের হিসেব, সেই সাথে রয়েছে ব্যস্ত সময় থেকে এক লহমার মুক্তি।
একদিনের ছোট্ট ট্যুরে ঢাকার খুব কাছেই এক কাপড়ে চলে যেতে পারেন নরসিংদী। ব্যাগ ট্যাগ কিছু নেয়ার দরকার নেই। আর যদি বর্ষায় যান তবে দেখতে পাবেন পুরো নরসিংদী জুড়ে চলে লটকনের মহা উৎসব। সেই সাথে দেখে নিতে পারেন প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব ওয়ারী বটেশ্বর।
উয়ারী ও বটেশ্বর মূলত দুটি আলাদা গ্রাম। তবে গ্রাম দুটি পাশাপাশি থাকায় এবং সেখানে প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধধর্মের প্রচুর নিদর্শনের খোঁজ মেলায় একসাথে ‘উয়ারী-বটেশ্বর’ নামেই পরিচিত। ঢাকা থেকে দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার, আর নরসিংদী জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার পাশে গ্রাম দুটির দেখা মেলে।
এই প্রত্ননগরী ‘উয়ারী-বটেশ্বর’ আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান এবং তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠানের। ১৯৩৩ সালে উয়ারী গ্রামে কিছু শ্রমিক মাটি খনন করার সময় একটি মাটির পাত্রে কিছু মুদ্রা পায়। অধিকাংশ মুদ্রা হাত বদল হয়ে গেলেও হানিফ পাঠান জানতে পেরে দ্রুত ৩০-৩৫টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিল তৎকালীন ভারত এবং বঙ্গদেশের প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রা। এ থেকে তিনি নিশ্চিত হন যে, নিশ্চয়ই গ্রামটির মাটির নিচে লুকিয়ে আছে অতীত ঐশ্বর্য্যের কোনো না কোনো নির্দশন। পরে এটি পরিপূর্ণভাবে খনন করা হয়।
উয়ারী বটেশ্বর ঘুরে দেখার ফাকে ফাকেই হাটা পথে যা চোখে পড়বে তা হলো লটকন। চারদিকে খালি লটকন গাছ। যদি ঠিক সিজনে যান তবে দেখতে পাবেন গাছগুলো জুড়ে কেবল হলুদ রঙের ফল। থোকায় থোকায় লটকন ঝুলছে গাছের শরীরজুড়ে। এমনকি গাছের গোড়ার দিকে ঝুলে থাকা লটকন মিশেছে মাটির সঙ্গেও। বলা যায় লটকনে পরিপূর্ণ থাকে বাগানের প্রায় সব গাছ। এমন বাগান আছে নরসিংদীর শিবপুর ও রায়পুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।
সবচেয়ে বেশি লটকন গাছের দেখা পাওয়া যায় নরসিংদীর শিবপুরে। শিবপুর উপজেলার ছোটাবন্দ গ্রামে পা দিয়েই দেখা মিলবে অসংখ্য লটকন গাছের। ইচ্ছেমতো লটকন খেতে পারবেন গাছ থেকে পেড়ে। তবে অবশ্যই বাগানের মালিকের সাথে কথা বলে নেবেন। তিনিই আপনাকে দেখিয়ে দেবেন কোন গাছের লটকন বেশি মিষ্টি আর কোন গাছেরটা টক!
জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত লটকনের পূর্ণ মৌসুম। তবে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্তও কিছু লটকন পাওয়া যায়। এখানকার লটকন বিক্রির হাট বসে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল বাজার বাসস্ট্যান্ড, শিবপুরের কামারটেক বাজার বাসস্ট্যান্ড, চৈতন্যবাজার ও গাবতলী বাজার। চাষিরা খুব সকালে লটকন ছিঁড়ে ছোট ঝুড়িতে ভরে নিয়ে আসেন বাজারে। সকালেই বাজার জমে। পাইকার আসেন ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে। অনেক পাইকার বাগান থেকেও কিনে নেন।
দেশের অন্যান্য আরও অনেক এলাকাতে লটকন হয়। তবে স্বাদের সেরা লটকন পাবেন এখানেই। বাগান ভ্রমণের সাথে সাথে কিনে নিয়ে যেতে পারেন প্রিয়জনদের জন্যেও। নরসিংদীর গ্রামগুলোও কিন্তু খুব সুন্দর, চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ।
নরসিংদী যেভাবে যাবেন
ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে বামে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে একটু এগুলেই নরসিংদী। ঢাকা থেকে নরসিংদীর দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার। গুলিস্তান,সায়েদাবাদ ও আব্দুল্লাহপুর থেকে নরসিংদীর বাস পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরিবহন ৫ মিনিট পর পর নরসিংদী যাচ্ছে। যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। ট্রেনেও নরসিংদী যেতে পারবেন। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নরসিংদী যেতে ট্রেনে সময় লাগে ১ ঘণ্টার মতো।
যেখানে থাকবেন
নরসিংদী সকালে এসে ঘুরেফিরে রাতেই ঢাকা ফেরা সম্ভব। শহরে থাকা-খাওয়ার বেশ কয়েকটি ভালো হোটেল আছে। নরসিংদী শহরে আছে ডাকবাংলো, রয়েছে আবাসিক হোটেলও।
Add Comment
You must be logged in to post a comment.