স্বাধীনতা জাদুঘর; ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গর্বের স্বারক - Hosted By Maasud Rana
Promo Video
ঢাকার অসহনীয় যানজটে বিরক্ত হয়ে গেলে ঘুরে আসতে পারেন শাহবাগে অবস্থিত স্বাধীনতা জাদুঘর থেকে। পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়ানোর ছলে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে।
বাঙালি ঐতিহ্যের সমুজ্জ্বল এক নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এখান থেকেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর।
টেরাকোটার ম্যুরাল:
স্বাধীনতা জাদুঘরে প্রবেশের পথেই দর্শনার্থীদের চোখে পড়বে নান্দনিক টেরাকোটার ম্যুরাল। বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সম্পূর্ণ চিত্র টেরাকোটার ম্যুরালের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্লাস টাওয়ারের পাশের দেয়ালে এই ম্যুরাল। ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ ম্যুরালের মাধ্যমে শুরু হয়েছে টেরাকোটার কাজ। এরপর ধারাবাহিকভাবে সাজানো আছে ৪৭ সালের দেশভাগ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ৬ দফা, ৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা অর্জনের বিভিন্ন ইতিহাস।
গ্লাস টাওয়ার:
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আরো একটি অন্যতম স্থাপনা টাওয়ার হচ্ছে গ্লাস টাওয়ার। স্বাধীনতা জাদুঘরের প্লাজা চত্বরে অবস্থিত ইস্পাতের কাঠামোয় তৈরি এই গ্লাস টাওয়ার। স্থাপনাটি ১৫০ ফুট উচ্চতা আর ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৬ ফুট প্রস্থের। এ টাওয়ারটির আলোকছটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছে। স্বচ্ছ কাচের স্থাপনাটিতে দিনের বেলায় সূর্যের আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলন হয়। এছাড়া রাতের বেলা দেখা যায় বৈদ্যুতিক আলোর আলোকছটা।
স্বাধীনতা জাদুঘর দেখতে আসা দর্শনার্থীদের মন প্রথমেব কেড়ে নেয় এর চমৎকার স্থাপত্যশৈলী। মাটির নিচে অবস্থিত জাদুঘরটির বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে ফাঁকা জায়গা। প্লাজা চত্বরে টেরাকোটা ম্যুরালের নিচের অংশে এই জাদুঘরের অবস্থান। মূল গ্যালারিতে প্রবেশ করার জন্যে রয়েছে ওপর থেকে নিচে প্রসারিত প্রবেশপথ। প্রবেশের সময় রঙিন কাচের ভেতর থেকে হালকা সবুজ আলো দেখে মনে হতে পারে এটি কোনো গহিন সুড়ঙ্গ পথের প্রবেশ পথ।
স্বাধীনতা জাদুঘরের সংগ্রহশালা:
এখানকার সংগ্রহশালা তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ের অমূল্য সব দলিল সংরক্ষিত আছে। জাদুঘরটির প্রথম অংশে আছে, বাংলা ভাষা ও বাংলার উৎপত্তির নানান সময়ের ও স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সময়কার আন্দোলনের স্থিরচিত্র। ১৯৫২ সালে ভাষা সৈনিকদের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সময়কার ও মুক্তিযুদ্ধর সময় শরনার্থীদের করুণ ছবির কালেকশন রয়েছে এখানে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি ছবি আকারে সাজানো আছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে প্রচারণার জন্য তৈরিকৃত বিভিন্ন পোস্টারও জাদুঘরটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং স্থাপনার চিত্রও রয়েছে এখানে। এই গ্যালরি শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বড় একটা ছবি দিয়ে।
দ্বিতীয় অংশে রয়েছে একটি অন্ধকার কুঠুরি। সেখানে রয়েছে একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর দুর্লভ ছবি। জাদুঘরটির ২য় গ্যালারির দুপাশের দেয়ালে কাচের প্যানেলেই রয়েছে তিনশতর বেশি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র। ২৫ মার্চ কাল রাতের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে দুর্লভ আলোকচিত্রে। নির্যাতন কুঠুরির এই গ্যালারির নাম দেয়া হয়েছে ‘কালো অধ্যায়’।
জাদুঘরটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। জাদুঘর প্লাজাটি ৫৬৬৯ বর্গমিটার বিশিষ্ট টাইলস দ্বারা আবৃত। আর এই জাদুঘরের মাঝখানে রয়েছে একটি ঝর্ণা, যাতে উপর থেকে পানি পড়ে। এটির নাম অশ্রুপ্রপাত। যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখো শহীদের মায়ের অশ্রুকেই প্রতীকীরুপে দেখানো হয়েছে।
তৃতীয় গ্যালারিতে বাঙালির লড়াই-সংগ্রাম ও বিজয়ের বিভিন্ন স্থির চিত্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অপারেশন ও আন্তর্জাতিক দেশগুলার সহযোগিতার ছবি। বাঙালির বিজয় অর্জনের ছবির মধ্য দিয়ে এই গ্যালারির শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে স্মৃতি বিজড়িত কিছু ছবিও রয়েছে এই অংশে। বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের সাথে বঙ্গবন্ধুর দুলর্ভ ফটোগ্রাফের কালেকশন রয়েছে এই গ্যালারিতে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণের পর যে টেবিলে বসে সই করেছিলেন, তার একটি অনুলিপিও রয়েছে এই জাদুঘরে। মূল টেবিলটি রাখা আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। স্বাধীনতা জাদুঘরে রয়েছে একটি বড় অডিটোরিয়াম। যেখানে ১৫৫ জন এক সাথে ম্যুভি কিংবা ডকুমেন্টরি ফিল্ম দেখতে পারে।
জাদুঘর খোলা/বন্ধের সময়:
গ্রীষ্মকালে প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শীতকালে জাদুঘরটি খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪.৩০টা পর্যন্ত। শুক্রবার বিকেল ২.৩০টা থেকে স্বাধীনতা জাদুঘর সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। স্বাধীনতা জাদুঘর যেদিন খোলা থাকে সেদিন অডিটোরিয়ামে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টরি। আর শুক্র ও শনি বার দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা।
জাদুঘরটিতে প্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশমূল্য ২০ টাকা, শিশু-কিশোরদের জন্য ১০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকের জন্য প্রবেশ মূল্য ৩০০ টাকা ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের খরচ করতে হবে ৫০০ টাকা।
জাদুঘরের ভেতর থেকে বের হওয়ার সময় চোখে পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের জলন্ত স্মারক শিখা চিরন্তন। যেটি বাঙালির শৌর্যবীর্য আর অহংকারের প্রতীক। এটিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই অবস্থিত। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ স্থানে দাঁড়িয়েই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.