পাহাড়, নদী আর গাছপালা দিয়ে ঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সোমেশ্বরী নদী দেখলে যে কারো মন ভরে যাবে। দুর্গাপুরের আসল সৌন্দর্যই বলা হয়ে থাকে এই সোমেশ্বরী নদীকে।
সোমেশ্বরী নদীর উৎপত্তিস্থল আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে ভারতে হলেও আমাদের নেত্রকোণার দূর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর (বাংলাদেশের একমাত্রসাদা মাটির পাহাড় নামে খ্যাত) ও ভবানীপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে এই সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বছরের বেশিরভাগ সময় সোমেশ্বরীর একপাশ জুড়ে থাকে ধু ধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল। শীতে এর পানি হাঁটুজল থাকলেও বর্ষায় যেমন এর পানি বেড়ে যায় অনেক। সেই সময় এই পানিতে পা ডুবিয়ে হেঁটে বেড়াতে খুব ভালো লাগে। এর স্বচ্ছ পানিতে নামার লোভ আটনো খুবই কঠিন। এ পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে গেলে মোটা বালু পায়ের পাতায় শিরশির অনুভূতির সৃষ্টি করে।
সোমেশ্বরী নদীর দৃশ্য এবং দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রকৃতিক পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের ভালো লাগবে। সারাদিন সোমেশ্বরী নদী ঘুরে ও তার দু’পাড়ের আদিবাসী মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন, শিল্প-সংস্কৃতি ও কালচারাল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’ (সোমেশ্বরী নদীর আগের নাম)। ওই নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল।
১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা ইত্যাদি তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ এলাকাটি মুখর থাকত। এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এ স্থানটিই উত্তম। সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে।
সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর (বর্তমান নেত্রকোনা জেলায়) গ্রাম। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। সোমেশ্বর তার আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’। এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে।
ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎদেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী। তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী। সেদিনের সেই সোমেশ্বরী নদীই বর্তমান নেত্রকোনা জেলার ভেতর দিয়ে অবিরাম বয়ে চলেছে।
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে নেত্রকোনা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। বাসে করে গিয়ে দুর্গাপুর বাজার নামতে হবে। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে যেতে পারবেন সোমেশ্বরী নদীতে।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.