বাঙালি চিরকালই খাদ্যরসিক। তাদের নানা ধরণের মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি পিঠাও সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার। কেননা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে পিঠা। শুধু খাবার হিসেবে নয়, লোকজ ঐতিহ্য এবং নারীসমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারক হিসেবেও বিবেচিত হয় পিঠা। বাংলার বিভিন্ন উৎসব কিংবা বিশেষ কোনো আচার অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরির প্রচলন আদিকাল থেকেই।
অঞ্চল ভেদে পিঠার নামের জৌলুশের জন্য দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেয়েছে। আজ আমরা জানবো বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পিঠার কথা। পিঠার নাম ‘চুঙ্গাপুড়া’, এটি চুঙ্গা পিঠা নামেও পরিচিত।
এই চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল। বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল, ঢলুবাঁশ ও চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি এই খাবারটি সিলেটের একটি নিজস্ব এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পরিচিত। গোলাকার আকৃতির ঐতিহ্যবাহী এই পিঠা দুধের মালাই, খেজুরের গুড় ও দুধের সর দিয়ে পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে যেহেতু শীতকালে পিঠা খাওয়ার প্রচলণ বেশি, তাই এই সময়ে সিলেট ভ্রমণে গেলে হয়তো কোনো রাস্তার পাশে কিংবা কোনো হোটেলে এই পিঠা পেয়ে যেতে পারেন। অথবা সিলেটে যদি কোনো আত্মীয় থাকে, তাহলে এই পিঠাটি একবার ট্রাই করার জন্য হানা দিতে পারেন তাদের বাড়ি।
আমাদের দেশে এক সময় বাজারে মাছের মেলা বসতো। সেসব মেলা থেকে মাছ কিনে অথবা হাওর-নদী হতে বড় বড় মাছ (রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর) ধরে নিয়ে এসে হাল্কা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় মাছ বিরান) চুঙ্গাপুড়া পিঠা খাওয়া সিলেট অঞ্চলের একটি অন্যতম ঐতিহ্য ছিল। বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে খাবার শেষে চুঙ্গাপুড়া পিঠা, মাছ বিরান আর নারিকেলের ও কুমড়ার মিঠা, বা রিসা পরিবেশন করা ছিল একটি ঐতিহ্য।
পূর্বে সিলেটের পাহাড়ি আদিবাসীরা বাঁশ কেটে চুঙ্গা বানিয়ে এর ভেতর ভেজা চাল ভরে তৈরি করত এক ধরনের খাবার। ধীরে ধীরে এ খাবার পাহাড়িদের কাছ থেকে সিলেট বাসীদের ঘরে চলে আসে। সময়ের পরিক্রমায় চুঙ্গা দিয়ে তৈরি করা এই খাবারটিই এখন চুঙ্গা পিঠা নামে পরিচিত।
চুঙ্গাপিঠা বানানোর জন্য ঢলুবাঁশ অবশ্যই প্রয়োজন। ঢলুবাঁশে এক প্রকার তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশের ভিতরে কলাগাছের পাতা প্যাঁচালোভাবে ঢুকিয়ে তার মধ্যে বিন্নি চাল ভরা হয়। পরে খড় দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে এই চুঙাপুড়া পিঠা তৈরি করা হয়। ঢলুবাঁশে অতিরিক্ত পরিমাণে রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.