বাংলাদেশের একেবারে উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়। হিমালয়ের নিকটস্থ জেলা হওয়ায় এখানকার ভূভাগে রয়েছে প্রচুর নুড়ি পাথর। বলা হয়, প্রাচীনকাল থেকে পাথর দেখেই একটি এলাকার বয়স নির্ণয় করা হয়। তাইতো এই পাথর সংরক্ষণের জন্য এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর ‘রকস মিউজিয়াম’।
জেলার সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. নামজুল হক একক প্রচেষ্টায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে গড়ে তোলেন এই জাদুঘরটি। এ অঞ্চলের ভূখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূমি-বৈশিষ্ট্য, প্রাগৈতিহাসিক নমুনা সংগ্রহ, নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণার জন্য এ মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়। সরকারি মহিলা কলেজের নিজস্ব ভবনে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথমে কলেজের একটি কক্ষে স্থাপিত হলেও পরে নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ২০০৮ সালে সরকার ‘রক মিউজিয়াম’-এর জন্য একটি দ্বিতীয়তলা ভবন নির্মাণ করে। তবে বড় বড় পাথরগুলো পড়ে আছে বাইরে, কলেজের আঙিনায় এখানে-সেখানে। দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত পাথর, বালি, এগুলোকে বর্ণনাসহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে কক্ষের মধ্যে। বাইরে সাজিয়ে রাখা পাথরগুলো নানা স্থান থেকে সংগৃহীত। জায়গার অভাবে অনেকগুলো পাথর বাইরে ফেলে রাখায় রোদবৃষ্টিতে এর রং বদলে যাচ্ছে।
প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক আর গবেষক আসেন এখানে। পাথরের পাশাপাশি এখানে এ অঞ্চলের আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, হাজার বছরের পুরাতন ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি প্রভৃতি স্থান পেয়েছে এখানে। আছে হাজার বছরের পুরনো দুটি নৌকা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এগুলো ব্যবহার করা হতো বলে গবেষকরা মনে করেন।
হাজার বছরের পুরনো চুক্তিনামা, মোগল সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ শাসনামলের রোপ্য ও তামার মুদ্রা এখানে সংরক্ষিত আছে। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য গৃহস্থালির জিনিসপত্র, চাষাবাদের উপকরণ এবং ধর্মীয় উপাসনার নানাবিদ দ্রব্যাদি এখানে সাজিয়ে রাখা আছে। শুধু তাই নয় পাথরের ওপরে লেখা চীন-নেপালি লিপির মুদ্রণ দেখা যায় এখানে। বার রকমের রঙিন বালু এই মিউজিয়ামকে করেছে সমৃদ্ধ। নানা নদীর তলদেশ থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে বালু আর মাটি যা কৌতূহলী দর্শকের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে সহায়তা করে। সারা বছরেই দর্শনার্থীরা আসেন এখানে। তবে শীতে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যায়। শুধু দেশেরই নয়, বিদেশি পর্যটকরাও আসেন এখানে।
রকস মিউজিয়ামে অভ্যন্তরীণ এবং উন্মুক্ত দুই ধরনের গ্যালারি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্যালারিতে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির, রং ও বৈশিষ্ট্যেও আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও নুড়ি পাথর। আছে সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, খনিজবালি, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি ও কঠিন শিলা। আরও আছে নদীর নিচে ও ভূগর্ভে প্রাপ্ত অশ্মীভূত কাঠ।
উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাহিট, ব্যাসল্ট, শেল, মার্বেলসহ বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে পাথর, নকশাকৃত অলংকৃত খিলান। বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙের কাদা।
পঞ্চগড়ের এই রকস মিউজিয়ামটিতে শুধু যে নানা ধরনের পাথর আছে তাই নয়। এখানে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক লোকজ ঐতিহ্যের বিশাল সংগ্রহ। গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় সাত কোটি বছর আগে পঞ্চগড় অঞ্চলের জনপদসহ হিমালয় পর্বতমালার বিস্তৃত ছিল, টেথিসনামক একটি অগভীর সমুদ্র। আর তাই প্রাকৃতিক বিবর্তনে এ অঞ্চল এখনো সাক্ষ্য বহন করছে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের। আর বুকে ধারণ করে রেখেছে নানা ধরনের শিলা, পাথর, বালি আর মাটি।
রকস মিউজিয়াম ছাড়াও পঞ্চগড়ের আশেপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলো হলো- মহারাজার দিঘী, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, ভিতরগড় দুর্গনগরী, গোলকধাম মন্দির, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, বার আউলিয়া মাজার শরীফ, তেঁতুরিয়া ডাক-বাংলো। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় দৃশ্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে খুব বেশি।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.