রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকার সদরঘাটের সন্নিকটে লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান বাহাদুর শাহ পার্ক। জায়গাটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এটি এক সময় ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেও পরিচিত ছিল। ছোট এই পার্কটির চারপাশে রাস্তা থাকায় পার্কটিকে একটি চত্বর বলে মনে হতে পারে।
আঠার শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা আন্টা নামে অভিহিত করত। সেখান থেকেই এসেছে “আন্টাঘর” কথাটি। ক্লাব ঘরের সাথেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই এ সংক্রান্ত একটি ঘোষনা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় “ভিক্টোরিয়া পার্ক”।
১৯৫৭ সালের আগ পর্যন্ত পার্কটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেয়া হয় এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সিপাহী বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় “বাহাদুর শাহ পার্ক”।
পার্কটি ডিম্বাকৃতি এবং লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এর পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে দু’টি প্রধান ফটক বা গেট রয়েছে। পার্কটির ভেতরে রেলিং এর পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা করা হয়েছে। পার্কটি ঢাকার অন্যতম প্রধান নৌবন্দর সদরঘাট এলাকায় ঢুকতেই লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত। পার্কটিকে ঘিরে ৭টি রাস্তা একত্রিত হয়েছে।
পার্কের চারপাশে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সহ বেশ কিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকার কারণে এটি পুরনো ঢাকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। পার্কের উত্তর পাশে রয়েছে সেন্ট থমাস চার্চ, উত্তর পাশেই অবস্থিত ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি ট্যাংক। উত্তর-পূর্ব কোনে আছে ঢাকার অন্যতম কলেজ কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ইসলামিয়া হাই স্কুল, পূর্ব পাশে রয়েছে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারি মুসলিম স্কুল, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। পার্কের ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশেই রয়েছে ঢাকার জজ কোর্ট। এছাড়া বাংলা বাজার, ইসলামপুর, শাখারী বাজারের মত ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু এলাকা থেকে বর্তমান ঢাকার নতুন এলাকায় আসতে এ পার্ক এলাকার রাস্তাটিই প্রধান সড়ক।
খাজা হাফিজুল্লাহ স্মৃতিস্তম্ভ:
খাজা হাফিজুল্লাহ ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার খাজা আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ঢাকার পরববর্তী নবাব হবেন এমনটি চিন্তা করে সবাই তাকে সমীহ করতেন এবং যত্নের সাথে লালন করতেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালে হঠাৎ হাফিজুল্লাহর অকাল মৃত্যুতে নবাব পরিবার তথা সাড়া ঢাকা শহরই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। পুত্রশোকে নবাব আহসানুল্লাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুত্রশোকের কারণে ইংরেজদের বিনোদনের পৃষ্ঠপোষক নবাব আহসানুল্লাহ তাদের আমোদ ফুর্তির জন্য কোন আয়োজন করতেন না। তখন ইংরেজরা নবাবকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য এবং খাজা হাফিজুল্লাহর স্মৃতিকে জীবিত রাখতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তার পরিচিতিমূলক একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন।
তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে গ্রানাইট পাথরের তৈরি বৃহদাকার স্মৃতিস্তম্ভ জাহাজে করে আনা হয়। স্তম্ভটির চারপাশ মসৃণ এবং চক চক করে তৈরি। গোড়ার দুই দিকে পরিচিতমূলক লিপি খোদাই করা রয়েছে। ১৮৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় বঙ্গের ছোট লাট সাহেব এক আড়ম্বরপূর্ণ অনু্ষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজা হাফিজুল্লাহ স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্ভোধন করেন।
এই পার্কের স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলার এর উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো। উপরে রয়েছে একটি ডোম। অপর পাশে রয়েছে একটি ওবেলিস্ক, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী হিসেবে রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহন মনে করিয়ে দেয়।
যেভাবে যাবেন:
আপনি দেশের যেখানেই অবস্থান করেন না কেন আপনাকে প্রথমে রাজধানী ঢাকায় আসতে হবে। তারপর ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে সদরঘাটগামী বাসে করে জনসন রোডে পৌঁছাতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চেনা থাকলে আপনার জন্য বাহাদুর শাহ পার্কটিকে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে, কেননা পার্কটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই অবস্থিত।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.