ধনবাড়ী নবাব প্যালেস; টাঙ্গাইলের কালের সাক্ষী - Hosted By S. faisal
Promo Video
ইতিহাস থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলায় বেশ কয়েকজন জমিদার বসবাস করতেন। সময় বদলে গেছে, কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে জমিদারদের রেখে যাওয়া সেই বাড়িগুলো। আকর্ষণীয় জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নবাব প্যালেস অন্যতম।
নদীঘেরা নির্মল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে জেলা টাঙ্গাইল। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এ জেলা পেয়েছে অন্যতম গ্রহণযোগ্যতা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তানদের তালিকা বেশ বড়। তবে জেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো এখানকার জমিদার বাড়িগুলো।
বৈরান ও বংশী নদীর মাঝখানে ১২০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত অপূর্ব এই নবাববাড়ি। নবাব বাড়িতে রয়েছে নবাব প্যালেস, আবাস ভবন এবং কাছারি ভবনসহ আরো কয়েকটি ভবন। রয়েছে কনফারেন্স হল, কনভেনশন হল, ডাইনিং হল, নবাব মিউজিয়াম ও পাঠাগার। তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ ও একটি সুন্দর বাগান। মনোরম এই নবাব বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে শত শত পর্যটক।
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলা। একসময় ধনপতি সিংহ নামে একজন নৃপতি এখানে রাজত্ব করতেন বলেই এর নাম হয়েছে ধনবাড়ি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলের সেনাপতি ইস্কান্দার খান এবং তার ভাই মনোয়ার খান এখানকার জমিদার ছিলেন। জমিদার ইস্কান্দার খান ও তার ভাই মনোয়ার খানের কবর এবং তাদের নির্মিত মসজিদ এখনো এখানে রয়েছে। তবে জমিদারি প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্য মতবাদও আছে। পাঠানদের পতনের যুগে সেলযুগ তুর্কিদের জমিদারি ছিল ধনবাড়িতে। আর এখানেই প্রায় ৭০০ বছর আগে স্থাপিত হয় ধনবাড়ি নওয়াব বাড়ি, যা বর্তমানে ধনবাড়ী নবাব প্যালেস নামে পরিচিত।
চার গম্বুজ বিশিষ্ট অপূর্ব স্থাপত্য রীতির শতাব্দী প্রাচীন এই নবাব প্যালেসটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। প্রাচীর ঘেরা নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেস এবং নবাব কাচারিকে বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সম্বলিত।
ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণের দু’পাশে রয়েছে প্রহরীদের দু’টি কক্ষ। জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গর্ভনরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তোরণটি নির্মাণ করেন। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দু’টি ছাড়াও রয়েছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, রান্নাঘর, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসী চত্বর। দর্শনার্থীদের জন্য এই নবাব প্যালেসে রয়েছে চার ধরনের আবাসন ব্যবস্থা। মঞ্জিল (মূল রাজপ্রাসাদ), প্যালেস (কাচারিঘর), ভিলা (২০০ বছরের পুরনো টিনশেড ভবন) এবং কটেজ (সম্প্রতি নির্মিত টিনশেড বাংলো)। মঞ্জিল এবং প্যালেসের খাট, সোফাসহ সব আসবাবপত্র সেই প্রাচীন আমলের; যা নবাবরা ব্যবহার করতেন।
সেলযুগ তুর্কি বংশের উত্তর পুরুষ ছিলেন রাজা আলী খাঁ সাহেব। তিনি বিয়ে করেন শাহ সৈয়দ খোদা বক্স এর কন্যা সৈয়দা তালিবুন্নেসা চৌধুরীকে। রাজা আলী খাঁ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্ত্রী তালিবুন্নেসা খোদাবক্সকে ধনবাড়ি জমিদারিতে নিয়ে আসেন। পরবর্তিতে তিনিই মালিক হন আলী খাঁর জমিদারির।
খোদাবক্সের ছেলে সৈয়দ মাহমুদ খাঁ, যার মাজার ধন বাড়িতে আছে। সৈয়দ মাহমুদ খাঁর একমাত্র ছেলে সৈয়দ জনাব আলী মারা যান খুব অল্প বয়সে। তার দুই সন্তান ছেলে সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী এবং কন্যা সৈয়দা সায়েরা খাতুন। সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আব্দুস সোবহান সাহেবের কন্যা আলতাফুন্নাহারকে। আলতাফুন্নাহার নিঃসন্তান ছিলেন। তার মৃত্যুর পর নওয়াব আলী বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর ওয়াকফ নামায় নওয়াব আলী চৌধুরীর তৃতীয় স্ত্রীর সাকিনা খাতুনের একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের কথা লেখা আছে। যিনি পরবর্তিতে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প মন্ত্রি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন দুই বাংলার প্রথম মুসলিম মন্ত্রী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুর পর তার একমাত্র সন্তান সৈয়দা আশিকা আকবর ১৯৮১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন নওয়াব আলী চৌধুরী। সিলেটেও নওয়াব আলী চৌধুরী ভবন রয়েছে।
নবাব বাড়ির পাশেই রয়েছে নবাব বাড়ি মসজিদ। বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম। ষোড়শ শতাব্দীতে সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ দুই ভাই এ মসজিদটির প্রথম খন্ড (এক কক্ষ বিশিষ্ট মসজিদ) নির্মাণ করেন। মোঘল সম্রাট আকবরের সময় এ দুই ভাই ধনবাড়ির অত্যাচারী জমিদারকে যখন পরাজিত করে এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন এ মসজিদটি নির্মাণ হয়।
পরবর্তীকে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। কড়ি পাথরের মোজাইক করা প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এটি। মসজিদের জমিন ও ভেতরের দেয়ালে কড়ি পাথরের লতাপাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা রয়েছে। বাইরের দেয়ালেও রয়েছে সিমেন্ট আর কড়ি পাথরের টোরাকাটা নকশা।
চীনা-মিশরীয়দের তৈরি মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদটির মোজাইকসমূহ এবং মেজেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারম্নকার্য অসাধারণ। চারদিকে চারটি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা, ছোট-বড় মোট ৩৪টি গম্বুজ। বড় ৭টি গম্বুজের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট। ধনবাড়ি নওয়াব শাহী জামে মসজিদের মিম্বর বেশ প্রাচীন এবং আকর্ষণীয়। এর উচ্চতা পৌনে ৫ ফুট এবং প্রস্থ পৌনে ৩ ফুট। এখানে বসে ইমাম খুতবা পাঠ করেন। মসজিদের দোতলা মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। এ মসজিদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হলো ১০টি চূড়া বিশিষ্ট তামার চাঁদ, মোঘল আমলের ৩টি ঝাড়বাতি এবং ১৮টি হাড়িবাতি (নারকেল তেলে ব্যবহৃত হতো) র্বতমানে মসজিদের কক্ষে শোভা পাচ্ছে। শিলালিপিতে ১৩১৯ হিজরিতে মসজিদ তৈরির কথা লেখা রয়েছে। মসজিদ নির্মাণে চুন, সুরকি, সাদা সিমেন্ট, কড়ি পাথর, লোহার খাম ইত্যাদি ব্যবহার হয়েছে।
নওবাব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালের ১৭ এপ্রিল দার্জিলিং (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে) ইডেন ক্যাসেলে ইন্তেকাল করেন। নবাব বাড়ি মসজিদের একপাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি। এছাড়া ধর্ম প্রচারের কাজে ইয়ামেন থেকে আগত কয়েকজন পীরের কবরও আছে এই মসজিদ প্রাঙ্গণে। নওয়াব আলীর মৃত্যুর ১৯২৯ সাল থেকে টানা ৮৪ বছর ধরে তার কবরের পাশে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। ৫ জন ক্বারী অবিরাম এই কোরআন তেলাওয়াত করে যান। নামাজের সময় ছাড়া এই কোনআন তেলাওয়াত কখনো বন্ধ হয় না। মসজিদটির সামনে রয়েছে ৭ বিঘা জমির এক বিশাল দীঘি।
সেলজুক তুর্কি আর মোঘল স্থাপত্যের অমূল্য নির্দেশন ধনবাড়ী নবাব প্যালেস ও মসজিদ। বর্তমানে সৈয়দ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর জমিদারি নবাব আলী হাসান আলী রয়েল রির্সোট সেন্টার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
Add Reviews & Rate
You must be logged in to post a comment.